বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার কাঠামো: সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

বাংলাদেশের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার জটিলতা কাটাতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দুটি বিকল্প প্রস্তাব করেছে:  

১. প্রাদেশিক মডেল: ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী—এই ৪টি প্রদেশে দেশকে বিভক্ত করে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন জোরদার করা।  

২. বিভাগীয় সম্প্রসারণ: কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে নতুন বিভাগ হিসেবে যুক্ত করে মোট ১০ বিভাগ বজায় রাখা।  

এই ব্লগে আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাদেশিক সরকারের সম্ভাব্য সুবিধা-অসুবিধা ও কোন পথটি যুক্তিযুক্ত তা বিশ্লেষণ করব।

---

১. বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামো: কেন্দ্রীয়করণের চ্যালেঞ্জ

- বর্তমান ব্যবস্থা: ৮টি বিভাগ ➔ ৬৪টি জেলা ➔ ৪৯৫টি উপজেলা।  

- সমস্যা:

  - কেন্দ্রীয় নির্ভরতা: ৯০% সিদ্ধান্ত ঢাকা থেকে নেওয়া হয় (বিবিএস, ২০২৩)।  

  - অসম উন্নয়ন: জিডিপির ৪০% ঢাকা বিভাগে কেন্দ্রীভূত (বাংলাদেশ ব্যাংক)।  

  - স্থানীয় পর্যায়ে দুর্বলতা: উপজেলা পরিষদগুলোর আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা সীমিত।  

---

২. প্রাদেশিক সরকার কাঠামোর প্রস্তাব: সম্ভাবনা ও ঝুঁকি

ক. প্রস্তাবিত মডেল:

- ৪টি প্রদেশে বিভক্ত করা হবে, প্রতিটির নিজস্ব প্রাদেশিক পরিষদ, বাজেট ও নীতি-নির্ধারণ ক্ষমতা থাকবে।  

- প্রদেশগুলোর মধ্যে সম্পদ বণ্টন ও সমন্বয়ের জন্য একটি জাতীয় কাউন্সিল গঠন।  


খ. সুবিধা:

- বিকেন্দ্রীকরণ: স্থানীয় সমস্যার স্থানীয় সমাধান (যেমন: চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের উন্নয়ন)।  

- অর্থনৈতিক ভারসাম্য: খুলনা-রাজশাহীতে শিল্প-কৃষি ভিত্তিক স্বতন্ত্র অর্থনীতি গড়ে তোলা।  

- রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: প্রাদেশিক নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় নেতৃত্বের উত্থান।  


গ. চ্যালেঞ্জ:

- জাতীয় ঐক্যের ঝুঁকি: বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রাদেশিকতাবাদের অভিজ্ঞতা নেই।  

  - উদাহরণ: ১৯৪৭-১৯৭১ সালের প্রাদেশিক বৈষম্য (পূর্ব পাকিস্তান vs. পশ্চিম পাকিস্তান)।  

-  জাতিগত উত্তেজনা: পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী অঞ্চলে প্রাদেশিক মডেল জটিলতা বাড়াতে পারে।  

- অর্থনৈতিক ব্যয়: ৪টি প্রাদেশিক রাজধানী, প্রশাসনিক কাঠামো ও কর্মকর্তা নিয়োগে বিশাল বাজেট প্রয়োজন।  

- রাজনৈতিক প্রতিরোধ: কেন্দ্রীয় ক্ষমতা হারানোর ভয়ে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা।  

---

৩. বিভাগীয় সম্প্রসারণ মডেল (১০ বিভাগ):

ক. প্রস্তাবিত কাঠামো:

- নতুন বিভাগ: কুমিল্লা (চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে আলাদা) ও ফরিদপুর (ঢাকা বিভাগ থেকে আলাদা)।  

- সুবিধা:

  - কম ঝুঁকি: বিদ্যমান বিভাগীয় কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।  

  - দ্রুত বাস্তবায়ন: প্রশাসনিক অবকাঠামো ও জনবল স্থানান্তর সহজ।  

  - স্থানীয় সেবা: কুমিল্লা ও ফরিদপুরের ২ কোটি মানুষকে নিকটবর্তী সদর দপ্তরের সুবিধা।  


খ. সীমাবদ্ধতা:

- অর্ধ-বিকেন্দ্রীকরণ: বিভাগীয় কমিশনারের ক্ষমতা সীমিত, প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন নেই।  

- কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ: অর্থবরাদ্দ ও নীতিনির্ধারণে ঢাকার উপর নির্ভরতা কমবে না।  

---

৪. আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা: শিক্ষা

- সফল মডেল:

  - ভারতের রাজ্য ব্যবস্থা: ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক রাজ্য গঠনে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য অর্জন।  

  - জার্মানির ফেডারেলিজম: রাজ্যগুলোর স্বায়ত্তশাসন জাতীয় ঐক্যের সাথে সহাবস্থান।  

- ব্যর্থ উদাহরণ:

- পাকিস্তানের প্রাদেশিক বৈষম্য: সম্পদ বণ্টনে অসমতা গৃহযুদ্ধের কারণ হয়েছিল।  

---

৫. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন মডেল যুক্তিযুক্ত?

ক. প্রাদেশিক মডেলের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত:

- সংবিধান সংশোধন: অধ্যায় ১ (প্রজাতন্ত্র) ও অধ্যায় ২ (রাষ্ট্রীয় নীতি) পরিবর্তন।  

- জাতীয় ঐক্যমত: প্রধান রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও সামরিক বাহিনীর সমর্থন।  

- অর্থনৈতিক সক্ষমতা: প্রাদেশিক বাজেট মেটাতে জিডিপির ৩০% রাজস্ব বিকেন্দ্রীকরণ (বর্তমানে মাত্র ১২%)।  


খ. বিভাগীয় সম্প্রসারণ মডেলের সুবিধা:

- অপারেশনাল সহজতা: বর্তমান আইনে বিভাগ বাড়ানো যায় (স্থানীয় সরকার (বিভাগ) অধ্যাদেশ ১৯৭৬)।  

- রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা: কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হ্রাসের ভয় নেই।  

- পর্যায়ক্রমে বিকেন্দ্রীকরণ: প্রথমে বিভাগীয় পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর, পরে প্রাদেশিক মডেলের দিকে যাওয়া।

---

৬. সুপারিশ: পর্যায়ক্রমে বিকেন্দ্রীকরণ

বাংলাদেশের ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বিভাগীয় সম্প্রসারণ মডেল অধিক বাস্তবসম্মত। তবে দীর্ঘমেয়াদে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য নিচে পদক্ষেপ প্রয়োজন:  

১. বিভাগীয় স্বায়ত্তশাসন: কুমিল্লা ও ফরিদপুরসহ ১০ বিভাগকে অর্থনৈতিক করিডোর হিসেবে গড়ে তোলা।  

২. উপজেলা শক্তিশালীকরণ: স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইন ২০২৩ বাস্তবায়ন করে আর্থিক ক্ষমতা হস্তান্তর। 

---

৭. উপসংহার

প্রাদেশিক সরকার কাঠামো একটি সাহসী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ, কিন্তু বাংলাদেশে এটি বাস্তবায়নের আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আর্থিক সক্ষমতা ও সামাজিক ঐক্য জরুরি। অন্যদিকে, বিভাগীয় সম্প্রসারণ ও উপজেলা-ভিত্তিক বিকেন্দ্রীকরণই বর্তমানে সর্বোত্তম বিকল্প। সংস্কারের সাফল্য নির্ভর করবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নাগরিক অংশগ্রহণের উপর।

---

🖊️Md. Abdulla

**পড়ার জন্য ধন্যবাদ!**  

আপনার মতামত কমেন্টে শেয়ার করুন অথবা [সোশ্যাল মিডিয়া] তে শেয়ার করে আলোচনায় অংশ নিন। 

**#প্রশাসনিক_সংস্কার #বাংলাদেশ #বিকেন্দ্রীকরণ**


---

তথ্যসূত্র

- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS), ২০২৩  

- স্থানীয় সরকার বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ  

- বিশ্বব্যাংক রিপোর্ট: "Decentralization in South Asia" (২০২২)  

---

No comments:

Post a Comment

আহলান সাহলান মাহে রমাদান

সকলকে পবিত্র মাহে রমজানের শুভেচ্ছা।