গণতন্ত্র: অর্জন, সংকট ও সম্ভাবনার দ্বন্দ্ব

গণতন্ত্র শুধু একটি শাসনব্যবস্থা নয়—এটি নাগরিকের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতার সমন্বয়। বাংলাদেশ, একটি স্বাধীন ও সংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে, এর ৫৩ বছরের যাত্রায় গণতন্ত্রের সংজ্ঞাকে বারবার পুনর্ব্যাখ্যা করেছে। এই ব্লগে আমরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস, বর্তমান সংকট এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।

১. গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক যাত্রা

ক. স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগ (১৯৭১-১৯৭৫):

- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম।  

- ১৯৭২ সালে সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল গঠন। বাকশাল গঠনের পর শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসনের সূচনা। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গনতান্ত্রিক যাত্রা।


খ. সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম (১৯৭৫-১৯৯০):

- জিয়াউর রহমান (১৯৭৫-১৯৮১) গনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ (১৯৮২-১৯৯০) এর শাসনামলে আবারো গণতন্ত্র দমিত হয়।  

- ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান: ছাত্র-শ্রমিক-নাগরিক ঐক্যে এরশাদ সরকারের পতন, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার।  


গ. গণতন্ত্রের যুগ (১৯৯১-বর্তমান):

- ১৯৯১-২০০৬: বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে পালাবদলের রাজনীতি।  

- ২০০৮-বর্তমান: আওয়ামী লীগের টানা শাসনামল, যা "গণতান্ত্রিক একদলীয় প্রভাব" হিসেবে সমালোচিত।


২. বর্তমান গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ

ক. নির্বাচনী স্বচ্ছতার সংকট:

- ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দলের ব্যাপক অংশগ্রহণহীনতা ও অনিয়মের অভিযোগ।  

- ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল বিহীন ডামি নির্বাচন।

- ২০২৪ সালের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া।  


খ. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মিডিয়া:

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (২০১৮): সাংবাদিক ও Aktivists-দের বিরুদ্ধে মামলা দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ।  

প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০২৪: রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ১৬৩টি দেশের মধ্যে ১৬৫তম।  


গ. প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা:

- নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন।  

- রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা।  


ঘ. নাগরিক সমাজের ভূমিকা:

- যুবসমাজের রাজনীতিতে অনীহা: ৬০% তরুণ-তরুণী রাজনৈতিক দলে অনাস্থা প্রকাশ করে (ইউনিসেফ সমীক্ষা, ২০২৩)।  

- সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বাধীন আলোচনা vs. সরকারি নজরদারির দ্বন্দ্ব।  


৩. গণতন্ত্রের অর্জন

অর্থনৈতিক উন্নয়ন:

  - জিডিপি প্রবৃদ্ধি (২০২৩ সালে ৬.৫%), দারিদ্র্য হার কমেছে ১৮.৭% (বিবিএস)।  

নারীর ক্ষমতায়ন: সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত আসন।

ডিজিটাল বিপ্লব:

  - ই-গভর্নেন্স, মোবাইল ব্যাংকিং এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে নাগরিক ক্ষমতায়ন।  


৪. আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ:

  - RAB-এর উপর নিষেধাজ্ঞা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ।  

চীন-ভারতের প্রভাব:**  

  - চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ vs. ভারতের সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্ক।  

রোহিঙ্গা সংকট:

  - ১১ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চাপ।  


৫. ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথ

ক. সংলাপ ও সমঝোতা:**  

- সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে আলোচনা।  

- যুবসমাজকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা।  


খ. প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ:

- নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ এবং মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।  

- দুর্নীতি দমন কমিশন (ACC)-এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি।  


গ. শিক্ষা ও সচেতনতা:

- নাগরিক শিক্ষার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়া।  

- স্কুল-কলেজে গণতন্ত্র ও নাগরিক দায়িত্ববোধের পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা।  


৬. উপসংহার:

বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ একটি ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে। একদিকে অর্থনৈতিক সাফল্য এবং ডিজিটাল রূপান্তর, অন্যদিকে রাজনৈতিক এককেন্দ্রিকতা ও নাগরিক অধিকার হ্রাসের চ্যালেঞ্জ। টেকসই গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের মানুষ তাদের রক্ত দিয়ে যে গণতন্ত্রের বীজ বপন করেছিল, তা যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়—সেই প্রত্যাশাই রইল।


--- 

🖊️Md. Abdulla


**পড়ার জন্য ধন্যবাদ!**  

আপনার মতামত কমেন্টে শেয়ার করুন অথবা [সোশ্যাল মিডিয়া] তে শেয়ার করে আলোচনায় অংশ নিন।  

**#বাংলাদেশ_গণতন্ত্র #নাগরিক_অধিকার #রাজনৈতিক_সংস্কার**


আহলান সাহলান মাহে রমাদান

সকলকে পবিত্র মাহে রমজানের শুভেচ্ছা।